রংপুরের কাঁচামাল ব্যবসায়ী আশরাফুল হককে (৪২) প্রেমের ফাঁদে ফেলে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করে টাকা আদায় করার টার্গেট ছিল জরেজ ও তার কথিত প্রেমিকা শামীমা আক্তারের।এ জন্য এক মাস আগে আশরাফুলের সঙ্গে মিথ্যা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন শামীমা। পরে তাকে ঢাকায় এনে খুন করে লাশ ২৬ টুকরো করে জরেজুল ও শামীমা।শনিবার (১৫ নভেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন।তিনি জানান, ১৪ নভেম্বর সকালে কুমিল্লার লাকসামের বড় বিজরা এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে শামীমা আক্তারকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব সদস্যরা।
তিনি আরও জানান, গত ১১ নভেম্বর রাত ৮টায় ব্যবসায়ী আশরাফুল হক তার ব্যবসা সংক্রান্ত পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে একই গ্রামের বাসিন্দা বন্ধু জরেজুলের সঙ্গে রংপুর থেকে ঢাকায় রওয়ানা দেন। পরদিন সকাল থেকে আশরাফুলের পরিবার তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তা বন্ধ পায়। পরবর্তীতে গত ১৩ নভেম্বর হাইকোর্টস্থ পানির পাম্প সংলগ্ন দুইটি নীল রংয়ের ড্রামের ভেতর অজ্ঞাতনামা পুরুষের ২৬ খণ্ডের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আঙুলের ছাপ বিশ্লেষণ করে সিআইডি নিশ্চিত হয় লাশটি নিখোঁজ ব্যবসায়ী আশরাফুল হকের।
ওইদিন রাতেই নিহতের বোন বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় আশরাফুলের বন্ধু জরেজুলকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে এ ঘটনায় তদন্তে নেমে জরেজুলের প্রেমিকা শামীমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্য মতে নিহত আশরাফ এর রক্তমাখা সাদা রংয়ের পায়জামা-পাঞ্জাবিসহ হত্যার কাজে ব্যবহৃত দড়ি, কসটেপ, একটি গোলগলা গেঞ্জি এবং একটি হাফ প্যান্ট, একটি বস্তার ভেতর মুখবাঁধা অবস্থায় শনির আখড়ার নূরপুর এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন জানান, শামীমার সঙ্গে জরেজের এক বছরের অধিক সময় ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। জরেজুল শামীমাকে জানান, তার এক বন্ধুকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্লাকমেইল করে ১০ লাখ টাকা আদায় করা যাবে। এ টাকার ভাগে জরেজুল নেবে সাত লাখ, আর শামীমা নেবে তিন লাখ। ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী শামীমা নিহত আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে একমাস আগে থেকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ শুরু করে তার প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। মোবাইল ফোনে তাদের নিয়মিত অডিও এবং ভিডিও কলে কথা চলতে থাকে। পরবর্তীতে গত ১১ নভেম্বর রাত ৮টায় জরেজুল ভিকটিম আশরাফুলকে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা করেন। ঢাকায় আসার পর গত ১২ নভেম্বর জরেজুল ও আশরাফুল শামীমার সঙ্গে দেখা করে ঢাকার শনির আখড়ার নূরপুর এলাকায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটি বাসা ভাড়া করে তিনজন একত্রে ভাড়া বাসায় ওঠেন।তিনি আরও জানান, রংপুর থেকে ঢাকায় আসার আগে জরেজুল তার প্রেমিকা শামীমাকে ফোন কলে জানান, আশরাফুলের সঙ্গে সে যেন অন্তরঙ্গ ভিডিও ধারণ করে এবং সেই ভিডিও দেখিয়ে যাতে ১০ লাখ টাকা আদায় করা যায়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভুক্তভোগী আশরাফুলকে মালটার জুসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হালকা অচেতন করেন শামীমা। যাতে বাইরে থেকে জরেজুল অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ভিডিও ধারণ করলে আশরাফুল তা বুঝতে না পারে। পরবর্তীতে যখন তারা একান্ত সময় কাটায় তখন জরেজুল বাইরে থেকে ভিডিও ধারণ করেন। ওই ভিডিও শামীমার মোবাইলে ধারণ করা হয়, যা বর্তমানে উদ্ধারকৃত মোবাইলে রয়েছে।
শামীমার বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, গত ১২ নভেম্বর দুপুরে আশরাফুল পুরোপুরি অচেতন হয়ে পড়লে জরেজুল আশরাফুলের হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেন এবং মুখ কসটেপ দিয়ে আটকে দেন। জরেজুল অতিরিক্ত ইয়াবা সেবন করে উত্তেজিত হয়ে অচেতন থাকা ভিকটিম আশরাফকে হাতুড়ি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকেন। অতিরিক্ত আঘাত এবং মুখ কসটেপ দিয়ে আটকানো থাকায় শ্বাস না নিতে পেরে ঘটনাস্থলেই আশরাফুল মারা যান। পরে লাশ একই ঘরে রেখে জরেজুল ও শামীমা রাত্রীযাপন করেন এবং তারা শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়।
তিনি জানান, আশরাফুলের মরদেহ গুম করার উদ্দেশে গত ১৩ নভেম্বর সকালে জরেজুল নিকটস্থ বাজার থেকে চাপাতি ও ড্রাম কিনে আনেন। জরেজুল চাপাতি দিয়ে লাশ ২৬ টুকরা করে দুইটি নীল রংয়ের ড্রামে ভরে রাখেন। পরবর্তীতে দুপুর ২টা ৪৩ মিনিটে একটি সিএনজি ভাড়া করে ড্রাম দুটি সিএনজিতে নিয়ে দুপুর ২টা ৫২ মিনিটে বাসা থেকে রওয়ানা করেন। পথিমধ্যে তারা ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা চিন্তা করে সিএনজি পরিবর্তন করে অন্য একটি সিএনজিতে রওয়ানা করেন। দুপুর ৩টা ১৩ মিনিটে হাইকোর্ট মাজার গেটের কাছে এলে রাস্তায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা দেখে লাশ ভর্তি ড্রাম দুটি হাইকোর্টের পানির পাম্প সংলগ্ন প্রধান সড়কের পাশে একটি বড় গাছের নিচে ফেলে তারা অতি দ্রুত হাইকোট এলাকা থেকে একটি অটোরিকশাযোগে সায়দাবাদ চলে যান। সায়দাবাদ যাওয়ার পর জরেজুল শামীমাকে কুমিল্লায় তার নিজ বাড়িতে চলে যেতে বলেন এবং তিনি রংপুরে তার নিজের বাড়িতে চলে যাবেন বলে শামীমাকে জানান। সে অনুযায়ী শামীমা কুমিল্লা তার নিজ বাড়িতে যান এবং জরেজুলে সঙ্গে তার যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
তিনি আরও জানান, শামীমার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ব্লাকমেইল করে টাকা উপার্জন করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তবে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে পূর্ব শত্রুতা আছে কিনা তা মূল আসামি জরেজুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যাবে।
প্রসঙ্গত, এর আগে, গত রাতে র্যাব-৩ কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে শামীমাকে। আর মূলহোতা জরেজকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ঢাকা,শনিবার ১৫ অক্টোবর এইচ বি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।





















